প্রত্নতত্ব বিদেশে ভ্রমণ ভ্রমণ কাহিনী

নবাবের খোঁজে লক্ষ্ণৌয়ের বড় ইমামবারায়

উত্তম সেনগুপ্ত, উত্তর প্রদেশ ঘুরে

ভারতের উত্তর প্রদেশ যাওয়ার আগে শুনেছিলাম এটি ছিল নবাবদের রাজ্য। তাই আগ্রহ ছিল কিছু ঐতিহাসিক স্থান দেখার। তারই একটি লক্ষ্ণৌ শহরের বড় ইমামবারা।

মোগল সম্রাট আওধের (অযোধ্যা) নবাব উজির মীর্জা আমানি আসাফউদ্দৌলা বাহাদুর লক্ষ্ণৌতে ১৭৮৫ সালে বড় ইমামবারা নির্মাণ শুরু করেন। ১৭৯১ সালে নির্মাণ শেষ হয়।

কথিত আছে, ওই নির্মাণকালের মধ্যে তিন বছর ধরে উত্তর প্রদেশে চলছিল আকাল (খরা) তথা দুর্ভিক্ষ। ওই তিন বছর দিনে শ্রমিকরা ইমামবারায় নির্মাণ কাজ করত। আর রাতে অন্য একদল লোক সেই কাজের সিংহভাগ ভেঙ্গে ফেলত। আবার পরদিন শ্রমিকরা নতুন করে কাজ শুরু করত।

লক্ষ্ণৌর বাসিন্দারা মনে করেন, নবাব মূলত কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্যই ইমামবারা নির্মাণ শুরু করেছিলেন। এর স্থপতি ছিলেন কেফায়েতউল্লাহ খান ইরানী।

বিরাট এক দরজা দিয়ে বড় ইমামবারা চত্বরে প্রবেশ করলাম। সামনে সুন্দর বাগান আর বাগানের চারপাশ ঘিরে রাস্তা। বাগানের শেষে বিরাট এক কাঠের দরজা। এটি দ্বিতীয় প্রবেশ দ্বার। তারপর আবার বাগান।

এই বাগানটির মাঝ বরাবর রাস্তা। বাগানের শেষ প্রান্তে বড় ইমামবারা। এর উত্তর-পূর্ব কোণে ল্যাবেরিন্থ (গোলকধাঁধা) বা ভুল-ভুলাইয়া।

ইমামবারায় প্রবশের পর ওই প্রাঙ্গনেই ডান পাশে দেখতে পাবেন বড় একটি মসজিদ। নবাব আসফদ্দৌলার নাম অনুসারে একে বলা হয় আসফি মসজিদ।

ইসলাম ধর্মমতে ইমামবারা নির্মাণ করা হয় মূলত কারবালার প্রান্তরে শহীদ ইমাম হোসাইন এর আত্মত্যাগের স্মরণে। ইমামবারার ভেতরেই একটি হলের মাঝখানে আছে নবাব আসাফউদ্দৌলা এবং স্থপতি কেফায়েতউল্লাহ খান ইরানীর কবর। ইমামবারার প্রবেশর পরই দেখবেন ‘সিংহাসন’। সেখান থেকেই শুরু হয় মহররমের তাজিয়া মিছিল।

ইমামবারায় বেশ কয়েকটি বড় হল আছে। এরমধ্যে আছে চায়না হল, পার্সিয়ান হল ও ইন্ডিয়ান হল। পার্সিয়ান হলে শতবর্ষী আয়না, তাজিয়াসহ মহররমের বিভিন্ন অনুষঙ্গ রাখা আছে।

হলের চারপাশ ঘিরে এক মিটার প্রস্থের রেলিং দেয়া বারন্দা আছে। বারান্দা থেকে নিচের হলের ভেতরের সবকিছু দেখা যায়। বারান্দা ঘেরা দেয়াল আর ছাদের নকশাও অপরূপ।

ভুল ভুলাইয়া:

ইমামবারায় মূল আকর্ষণ ভুল ভুলাইয়া। মূলত ইমামবারার স্থাপত্য শৈলীর অংশ হিসেবেই স্তম্ভহীন এই ল্যাবেরিন্থটি নির্মাণ করা হয়। এখানে অসংখ্য গলিপথ থাকায় নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। তাই এটি ভুল ভুলাইয়া নামে পরিচিত।

এর যে পথ ধরেই যান না কেন ফিরতে হবে যাত্রা শুরুর স্থানে। দেয়ালের ভেতর আড়াই ফুট চওড়া রাস্তা। আছে আলো চলাচলের কার্নিশ। যত দূর থেকেই নিচু স্বরে কারো নাম ধরে ডাকুন না কেন যাকে ডাকছেন সে শুনতে পাবেই।

গাইড ছাড়া ভুল ভুলাইয়াতে যাওয়া ঠিক না। এখানে ৪৮৯টি দরজা আছে। কোন দরজা ধরে এগুলো কোথায় গিয়ে পৌঁছাবেন তা কে বলতে পারে।

ভুল ভুলাইয়া ঘুরে গেলাম ইমামবারার ছাদে। সেখানে আছে ছোট ছোট বেশ কিছু খিলানসহ গম্বুজ।

ছাদে গিয়ে দেখতে পেলাম লক্ষ্ণৌ শহরের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এখান থেকে রুমি দরজা, ছোট ইমামবাড়া, আসফি মসজিদ ও লক্ষ্ণৌ জামে মসজিদ দেখা যায়।

বাওলি:

চত্বরের বামপাশে ‘শাহী বাওলি’। আসলে এটি পাতকুয়া।

এটি ছিল নবাবদের কোষাগার। কথিত আছে, এই কুয়ায় নদী থেকে পানি আসত। আর এখানে কুয়ার পানির তলায় নবাবের গুপ্তধনের চাবি লুকানো থাকতো।

কুয়া ঘিরে তিন তলা বারান্দা। যার পিছনে আবার খিলান দেয়া বড় খোলা জানালার সারি।

এখানকার কুয়ার পানি আয়নার মত কাজ করে। বাওলির প্রবেশ পথের সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামতে থাকলে কুয়ার জলের আয়নায় তার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেত খিলনারে আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রহরীরা।

ইমামবারা প্রাঙ্গনে থাকা আসফি মসজিদ অনন্য স্থাপত্য শৈলীর কারণে ভ্রমণকারীদের নজর কাড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *